শিশু আইনের ৩১ (২) ধারাতেও শিশু–কিশোরদের বিচারপ্রক্রিয়ার অন্যতম বিবেচ্য বিষয় শিশু–কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্য। অথচ আমরা তাদের বিশেষায়িত জেলে পুরে নির্যাতন করছি। মানসিক চিকিৎসার ভাবনা আমাদের চিন্তাধারাতেই অনুপস্থিত।
মানসিক স্বাস্থ্যসেবাকে অগ্রাধিকার দিয়ে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রগুলো ঢেলে না সাজালে কিছুদিন পর পর যশোরের মতো ঘটনা ঘটতেই থাকবে। আর শিশু–কিশোর মনঃসামাজিক কাউন্সেলর নিয়োগবিধি প্রণয়ন করে উপযুক্ত একাডেমিক যোগ্যতা আর পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণকে নিয়োগের আবশ্যিক পূর্বশর্ত না করতে পারলে সাইকো–সোশ্যাল কাউন্সেলর পদমর্যাদার ব্যক্তিরাই অপরাধে জড়িয়ে পড়বেন। সকালে আড়মোড়া ভেঙে ঘুম থেকে উঠেই যে কেউ যেন নিজেকে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, কাউন্সেলর বা থেরাপিস্ট পরিচয় দিয়ে প্রতারণা করতে না পারে, সে জন্য বিএমডিসি, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট ও বার কাউন্সিলের আদলে স্বতন্ত্র লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষ থাকা প্রয়োজন।
সমাজ ও রাষ্ট্রকে যতই দায়িত্ব দিই না কেন, মনে রাখতে হবে সমাজের ক্ষুদ্রতম একক পরিবার। তাই পারিবারিক কাঠামো আরও সুসংহত করা ছাড়া কিশোর অপরাধ কমানো যাবে না। সন্তানকে কেবলই সফলতার ইঁদুরদৌড়ে ঠেলে দেওয়া থেকে বাবা-মায়েদের বেরিয়ে আসতে হবে। পরিবারে নৈতিকতার চর্চা বাড়াতে হবে। শিশুর সঙ্গে বা সামনে নিষ্ঠুর আচরণ থেকে বিরত থাকতে হবে। স্ক্রিনে নৃশংস দৃশ্য শিশুকে দেখানো যাবে না। বড় সময় স্কুলে কাটায় বলে শিশু-কিশোরদের ওপর শিক্ষকের আচরণ গভীর প্রভাব ফেলে। সেখানেও নিষ্ঠুরতা, বিদ্রূপ বা তুলনা পরিহার করতে হবে। সন্তানের মধ্যে অবাধ্য আচরণের লক্ষণ দেখলে দ্রুত মনোরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে।
দেখা গেছে, সংবাদমাধ্যমে কিশোর অপরাধ নিয়ে কিছু এলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎপর হয়ে উঠে শিশুদের আটক করে তথাকথিত ‘উন্নয়ন কেন্দ্রে’ পাঠিয়ে দেয়। সংবাদমাধ্যমে কিশোরদের ‘ভয়ংকর’ অভিধা দেওয়ার মাধ্যমে কৈশোর সম্পর্কে নেতিবাচক আর ভীতিকর দ্যোতনা তৈরি করা হয়। কিশোরকাল মোটেও ভয়ংকর নয়, বরং সম্ভাবনার সময়। পরিবার, রাষ্ট্র আর সমাজের কাজ সে সম্ভাবনার পথ খুলে দেওয়া। অপরাধী বলে দূরে না সরিয়ে তাদের সংশোধনের জন্য মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রাধান্য দিতে হবে, বিজ্ঞানসম্মত আধুনিক পদক্ষেপ নিতে হবে।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, চাইল্ড এডোলেসেন্ট অ্যান্ড ফ্যামিলি সাইকিয়াট্রি, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা