২০১১ সালের আগের জেলা পরিষদের কথা বাদ দিয়ে এই ৯-১০ বছরের অভিজ্ঞতা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, জেলা পর্যায়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা বিকেন্দ্রায়নের একটি জনপ্রতিনিধিত্বশীল কাঠামো হিসেবে জেলা পরিষদ পুনর্গঠন সময়োপযোগী ও সফল উদ্যোগ। স্থানীয় নেতৃত্বের ক্ষমতাচর্চার এ পরিসরের ১০ বছরের অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে এ প্রতিষ্ঠানের সম্ভাবনাকে নতুনভাবে যাচাই করার সময় আগত। ২০২১ সালের দ্বিতীয় নির্বাচনের আগে এখনকার মধ্যবর্তী সময়কে বাংলাদেশের জেলা পরিষদগুলোর একটি যুগসন্ধিক্ষণ বা ক্রান্তিকাল হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। তাই ভবিষ্যতে বিবেচনার জন্য বর্তমান জেলা পরিষদের কিছু সমস্যার বিশ্লেষণ প্রয়োজন।
১. বাংলাদেশের এককেন্দ্রিক সরকারব্যবস্থায় যদি কেন্দ্র থেকে প্রান্তে কোনো ধরনের ক্ষমতা বিকেন্দ্রায়নের প্রশ্ন আসে, তার প্রধান একক হবে জেলা। জেলা মাঠ প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু। কিন্তু দীর্ঘদিন জেলা, বিভাগ ও উপজেলা—এ তিনটি এককের সাধারণ, রেগুলেটরি, উন্নয়ন ও সেবা প্রশাসন ব্যবস্থার কোনো নির্মোহ মূল্যায়ন হয়নি। ১৯৪০ সালের ‘রয়েল কমিশন অন অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ডিসেন্ট্রালাইজেশন’-এর পর পাকিস্তান বা বাংলাদেশে বারবার নির্বাহী আদেশে নানা পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু সামগ্রিকতার বিবেচনায় নিরপেক্ষ ও সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য নিয়ে কোনো কমিটি/কমিশন কাজ করেনি। অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ চৌধুরীর নেতৃত্বে (১৯৭২-৭৩) গঠিত কমিটির যে সুপারিশ, পরবর্তীকালে তা বাস্তবায়িত হয়নি। বর্তমানে ডেপুটি কমিশনারকে বাংলায় ‘জেলা প্রশাসক’ বলা হলেও সত্যিকারের ‘জেলা প্রশাসন’ বলে কিছু খুঁজে পাওয়া যায় না। জেলাজুড়ে রয়েছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থার পৃথক নানা দপ্তর। সেসব দপ্তরের সবাই পৃথক ম্যান্ডেটসহ মন্ত্রণালয়ের অধীনেই কাজ করে থাকে। সরকারের চারটি বিশেষ প্রকৃতির যে দপ্তরগুলো (সাধারণ, রেগুলেটরি, সেবা ও উন্নয়ন) তাদের পারস্পরিক কর্ম-সম্পর্ক এবং সত্যিকারের অনুভূমিক সমন্বয় ও যোগাযোগ খুবই ক্ষীণ। জেলায় সরকারের সব কর্মকাণ্ডের মাঠপর্যায়ে কোনো কেন্দ্রবিন্দু নেই। জেলার নিজস্ব কোনো ভিশন বা পরিকল্পনা নেই। কিছুটা অত্যন্ত শিথিলভাবে ডিসি এবং অনানুষ্ঠানিকভাবে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে সাংসদেরা অথবা জেলার কোনো মন্ত্রী থাকলে তিনি তাৎক্ষণিক কোনো কোনো নির্দেশনা দপ্তরগুলোকে দিয়ে থাকেন। নতুবা প্রতিটি দপ্তর তাদের নিজ নিজ নিয়মেই পরিচালিত হয়। এ রকম একটি অবস্থায় দেশে গঠিত হলো জেলা পরিষদ। জেলা পরিষদ এই অবস্থায় একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজেকে খুঁজে পায় না। যেন তরঙ্গবিক্ষুব্ধ সাগরে এক ছোট্ট তরি। একদিকে রাজনৈতিকভাবে এমপি-মন্ত্রী, প্রশাসনিক দিক থেকে ডিসি-এসপিসহ সব সরকারি দপ্তর, নিচে উপজেলা ও ইউনিয়ন। আইনগতভাবে কারও সঙ্গে কার্যকর সম্পর্ক নেই, শুধু জেলার এমপিরা যথারীতি উপজেলা ও জেলা পরিষদের উপদেষ্টা। উপদেষ্টারা একটি কাজই জেলা পরিষদকে দিয়ে করান, তা হচ্ছে বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য অর্থ বরাদ্দের সুপারিশ। আইনগতভাবে জেলা পরিষদের সঙ্গে স্থানীয় সরকার বিভাগ তথা মন্ত্রণালয় ছাড়া অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের কার্যকর সম্পর্ক নেই। মন্ত্রণালয়ের পূর্বানুমোদন ছাড়া জেলা পরিষদ কোনো উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারে না। জেলার সামগ্রিক উন্নয়ন পরিকল্পনা বা উন্নয়ন সমন্বয়ে ডেপুটি কমিশনার কিংবা জেলা পরিষদ কারও কার্যকর ভূমিকা নেই।
২. জেলার অন্যান্য সরকারি উন্নয়ন ও সেবা দপ্তরের সঙ্গে জেলা পরিষদের কার্যকর আইনি সম্পর্কও ঐচ্ছিক। উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদ পৃথক আইনবলে গঠিত এবং জেলা পরিষদের সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্ক স্ব-ব্যাখ্যাত নয়।
৩. জেলা পরিষদ নির্বাচনের পরও জেলা পরিষদ ও মন্ত্রণালয়ের সম্পর্কে পরিবর্তন আসেনি। ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণ নির্বাচিত পরিষদ প্রতিষ্ঠার আগে যা ছিল, তা-ই অনুসরণ করা হচ্ছে।