বাংলার নবজাগরণের প্রত্যক্ষ ফসল হিসেবে গদ্যে যে ভূমিকা পালন করেছেন বিদ্যাসাগর পদ্যে সেই ভূমিকা পালন করেছেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। মাইকেলের প্রায় অর্ধশতাব্দীর জীবনে বিদ্যাসাগরের চেয়ে বড় কোনো শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন না।
১৮৬০ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর ‘পদ্মাবতী’ নাটক ও ‘তিলোত্তমাসম্ভব’ কাব্য। দুটিতেই অমিত্রাক্ষর ছন্দের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ ঘটান মাইকেল। শুরুতে বিদ্যাসাগর অমিত্রাক্ষর ছন্দকে পছন্দ করেননি। পরে তিনি মত পরিবর্তন করেন এবং প্রশংসা করেন। এতে প্রচণ্ড উচ্ছ্বসিত হয়ে রাজনারায়ণ বসুকে চিঠি লেখেন মাইকেল। ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ প্রকাশিত হওয়ার পর খ্যাতির চূড়ায় আরোহণ করলেন মাইকেল। কলকাতায় স্ত্রী-সন্তানকে রেখে বিলেত যাত্রা করলেন। এরপর তাঁর গন্তব্য ভার্সাই। কপর্দকশূন্য স্ত্রী-সন্তান ভার্সাইতে গেলেন। নিদারুণ অনটন, অসম্মান, পাওনাদারের তাগাদা আর জেলে যাওয়ার আশঙ্কা নিয়ে অস্থির হয়ে উঠেছিলেন মাইকেল।
বিদ্যাসাগরকে চিঠি লিখে জানানোমাত্র তিনি প্রয়োজনীয় অর্থ পাঠিয়ে দিলেন। বহুবার তাঁকে আর্থিক দুর্দশা থেকে রক্ষা করেছেন বিদ্যাসাগর। পাঁচ বছর পর বিলেত থেকে কলকাতায় ফিরে মাইকেল আইন ব্যবসা শুরু করলেন বিদ্যাসাগরের সাহায্যে। প্রচুর উপার্জন করলেন। কিন্তু অমিতব্যয়ী ও উচ্ছৃঙ্খল জীবনের কারণে নিঃস্ব হয়ে পড়লেন। হতাশ হয়ে বিদ্যাসাগর একটি চিঠিতে তাঁকে লিখলেন, ‘তোমার আর ভরসা নাই। আমি কি আর কেহই তোমাকে রক্ষা করিতে পারিবে না। তালি দিয়া আর চলিবে না।’ শত প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে বিদ্যাসাগর বাংলা সাহিত্যের অসামান্য প্রতিভা মাইকেলের পাশে দাঁড়িয়েছেন বারবার। বিদ্যাসাগরের চরিত্র সম্পর্কে মাইকেলের মূল্যায়ন অবিস্মরণীয়, ‘প্রাচীন ঋষিদের মতো প্রতিভা ও জ্ঞান, ইংরেজদের মতো প্রাণশক্তি আর বাঙালি মায়ের হৃদয়।’ মাইকেলই তাঁকে প্রথম বলেছিলেন ‘করুণাসাগর’।
যাঁরা মাইকেলের জীবদ্দশায় কোনো সাহায্য করেননি তাঁরা তাঁর মৃত্যুর পর দরদি হয়ে উঠলেন। মাইকেলের মৃত্যুর পর সিটি কলেজের অধ্যক্ষের উদ্যোগে তাঁর অস্থি ও পাঁজর সংরক্ষণের পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এ ব্যাপারে বিদ্যাসাগরের কাছে সাহায্য চাইতে গেলে তিনি বলেছিলেন, ‘প্রাণপণ চেষ্টা করিয়া যাহার জান রাখিতে পারি নাই, তাহার হাড় রাখিবার জন্য আমি ব্যস্ত নই। তোমাদের নূতন উৎসাহ ও আগ্রহ আছে, তোমরা কর।’ অতুলনীয় সুহৃদ বিদ্যাসাগরকে ঘিরেই রচিত হয়েছিল মাইকেলের অমর পঙ্ক্তি, ‘বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে।/ করুণার সিন্ধু তুমি, সেই জানে মনে,/ দীন যে, দীনের বন্ধু! উজ্জ্বল জগতে/ হেমাদ্রির হেম-কান্তি অম্লান কিরণে।’
রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘বিদ্যাসাগর এই বঙ্গদেশে একক ছিলেন। এখানে যেন তাঁহার স্বজাতি সোদর কেহ ছিল না। এ দেশে তিনি তাঁহার সমযোগ্য সহযোগীর অভাবে আমৃত্যুকাল নির্বাসন ভোগ করিয়া গিয়াছেন।’ সমকালীন বিশিষ্টজনদের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের অম্ল-মধুর সম্পর্কের রসায়ন বিশ্লেষণ করলে রবীন্দ্রনাথের কথার সারবত্তা প্রমাণিত হয়। ‘অজেয় পৌরুষ’ ও ‘অক্ষয় মনুষ্যত্ব’ নিয়ে বিদ্যাসাগর সমকালীনদের ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন।
অন্য আলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]