ডেনভারের ‘কান্ট্রি রোড’ গানটা একসময় খুব প্রিয় ছিল। এখন আর শুনতে ভালো লাগে না। কৌতুকের মতো মনে হয়। মেঠোপথ ধরে তো আমার কোনো ‘হোম’-এ যাওয়া হবে না কখনো। হোম বা ঘর মানে নিশ্চয়ই খুব নিরাপদ জায়গা? নিজের জায়গা। যেটা বিশ্বের আধাআধি মানুষেরই নেই; তাঁরা মেয়ে বলে। তাঁরা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সংখ্যালঘু বা কোণঠাসা দল বলে ।
হলফ করে বলতে পারি, আমার পুরুষ বন্ধুরা যে বয়সে সবচেয়ে বেশি কাতর হতেন মাকড়সা বা ভূতের ভয়ে, সে বয়সেই আমি ধর্ষণের মতো নৃশংসতার ভয়ে অস্থির থেকেছি। ভূতের ভয় সেখানে নস্যি, ছেলেমি ব্যাপার। সেই যে ১০/১২ বছর বয়সে মাথায় গেঁথে গেল, যেকোনো দিন যেকোনো বয়সী পরিচিত-অপরিচিত-স্বল্প পরিচিত যে কেউ মুখ চেপে ধরতে পারে, সেই শঙ্কা থেকে আর ছাড়া পেলাম না।
নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে এক নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের যে ঘটনা এখন মুখে মুখে ফিরছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেটি নিয়ে এখন বেদনা-অস্বস্তি-অনুতাপ আর প্রতিবাদের হাওয়া, সেই ভিডিও আমি দেখিনি। তবে না দেখেই বলে দিতে পারি, কী কী উপাদান ছিল সেখানে। নিশ্চয়ই সেখানে ধর্ষকদের প্রতি কাতর অনুনয় ছিল, সৃষ্টিকর্তার দোহাই দিয়ে বাঁচতে চাওয়ার আকুতি ছিল, কান্না আর গোঙানি ছিল। আর ছিল ধর্ষকদের উল্লাস, গালিগালাজ, অট্টহাসি। না দেখেই বলে দিতে পারি আমি। কারণ, বহু বছর ধরেই এমন একটা ছবি মাথায় নিয়েই ঘুরে বেড়াচ্ছি আমি, আমরা।
যেসব মানুষের জীবনের সঙ্গে এই প্রচণ্ড ভীতি আর নিরাপত্তাহীনতার যোগ নেই, তাঁদের কাছেই কেবল এ ঘটনা নতুন ঠেকছে। চমকে উঠেছেন তাঁরা। আসলে এটি নতুন ধরনের অতি নৃশংস কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। প্রতিটি ধর্ষণই আদতে এই একই রকমের রক্ত হিম করা ও ভয়াবহ।
না দেখা ভিডিওটির সবটাই আমার তাই দেখা ও জানা। প্রতিটি ধর্ষণের ঘটনায় আমিও তো রক্তাক্ত হই। কিন্তু সেই ক্ষত শুকানোর ফুরসত মেলে না। হপ্তায় হপ্তায় খাগড়াছড়ি, সিলেট, ঝিনাইদহ হয়ে শরীরে আমার দগদগে ঘা। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের দেওয়া হিসাবে গত নয় মাসে ৯৭৫ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। গণধর্ষণের শিকার ১০৮ জন।